Rabindranath Thakur Kobita List  – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা

WhatsApp Group Join Now
Instagram Profile Join Now
Telegram Channel Join Now

Rabindranath Thakur Kobita List

বিশ্ব কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ছোট কবিতা, প্রেমের কবিতা, শেষের কবিতা ইত্যাদি গুলি খুবই জনপ্রিয় । খ্যাতিমান কবিতার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যতম একজন তিনি প্রসিদ্ধ ছিলেন একজন দার্শনিক, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, কবি ও উপন্যাসিক হিসেবে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা গুলির মধ্যে তিনি প্রথম কবিতা লেখা শুরু করেন মাত্র ৮ বছর বয়সে তার প্রথম কবিতার নাম “অভিলাষ”। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্যতম যেটির নাম বিশ্ব কবি নামে খ্যাতিমান রয়েছেন উনাকে এই বিশ্বকবির আখ্যা দিয়েছিলেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতাগুলির মধ্যে রাজা ও রানী যেটি তিনি 1977 সালে রচিত করেছিলেন, এছাড়া বিসর্জন, বলিদান, ইত্যাদি এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনীর নাম হল “আমার কথায় আমার জীবন” এবং “ভানুসিংহ ঠাকুর” হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছদ্মনাম তিনি এখানে বাংলা ভাষাতে অনেক কবিতা রচিত করেছেন । এছাড়া তিনি প্রবন্ধ রচনা ক্ষেত্রে “পরশুরাম” ছদ্মনামে লিখতেন।

নিচে Bengali kobita rabindranath thakur এর ভালো কবিতা ও ১০ লাইন কবিতা গুলি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো ।

Bengali PoemClick Here
Bangla Premer KobitaClick Here
Bangla Romantic KobitaClick Here
Bangla Sad KobitaClick Here
Bangla Love KobitaClick Here
Rabindranath Thakur Kobita List  Click Here

অনন্ত প্রেম

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শতবার

জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।

চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয় গাঁথিয়াছে গীতহার–

কত রূপ ধরে পরেছ গলায়, নিয়েছ সে উপহার

জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।

যত শুনি সেই অতীত কাহিনী, প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,

অতি পুরাতন বিরহমিলন কথা,

অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে দেখা দেয় অবশেষে

কালের তিমিররজনী ভেদিয়া তোমারি মুরতি এসে

চিরস্মৃতিময়ী ধ্রুবতারকার বেশে।

আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগলপ্রেমের স্রোতে

অনাদি কালের হৃদয়-উৎস হতে।

আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা কোটি প্রেমিকের মাঝে

বিরহবিধুর নয়নসলিলে, মিলনমধুর লাজে–

পুরাতন প্রেম নিত্যনূতন সাজে।

আজি সেই চির-দিবসের প্রেম অবসান লভিয়াছে,

রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে।

নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ, নিখিল প্রাণের প্রীতি,

একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে সকল প্রেমের স্মৃতি–

সকল কালের সকল কবির গীতি।


অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে

চলবে না।

এবার হৃদয় মাঝে লুকিয়ে বোসো,

কেউ জানবে না, কেউ বলবে না।

বিশ্বে তোমার লুকোচুরি,

দেশ বিদেশে কতই ঘুরি –

এবার বলো আমার মনের কোণে

দেবে ধরা, ছলবে না।

আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে

চলবে না।

জানি আমার কঠিন হৃদয়

চরণ রাখার যোগ্য সে নয় –

সখা, তোমার হাওয়া লাগলে হিয়ায়

তবু কি প্রাণ গলবে না।

না হয় আমার নাই সাধনা,

ঝরলে তোমার কৃপার কণা

তখন নিমেষে কি ফুটবে না ফুল

চকিতে ফল ফলবে না।

আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে

চলবে না।


হঠাৎ দেখা

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা,

ভাবি নি সম্ভব হবে কোনোদিন।

আগে ওকে বারবার দেখেছি

লালরঙের শাড়িতে

দালিম ফুলের মতো রাঙা;

আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়,

আঁচল তুলেছে মাথায়

দোলনচাঁপার মতো চিকনগৌর মুখখানি ঘিরে।

মনে হল, কালো রঙে একটা গভীর দূরত্ব

ঘনিয়ে নিয়েছে নিজের চার দিকে,

যে দূরত্ব সর্ষেখেতের শেষ সীমানায়

শালবনের নীলাঞ্জনে।

থমকে গেল আমার সমস্ত মনটা;

চেনা লোককে দেখলেম অচেনার গাম্ভীর্যে।

হঠাৎ খবরের কাগজ ফেলে দিয়ে

আমাকে করলে নমস্কার।

সমাজবিধির পথ গেল খুলে,

আলাপ করলেম শুরু –

কেমন আছ, কেমন চলছে সংসার

ইত্যাদি।

সে রইল জানলার বাইরের দিকে চেয়ে

যেন কাছের দিনের ছোঁয়াচ-পার-হওয়া চাহনিতে।

দিলে অত্যন্ত ছোটো দুটো-একটা জবাব,

কোনোটা বা দিলেই না।

বুঝিয়ে দিলে হাতের অস্থিরতায় –

কেন এ-সব কথা,

এর চেয়ে অনেক ভালো চুপ করে থাকা।

আমি ছিলেম অন্য বেঞ্চিতে

ওর সাথিদের সঙ্গে।

এক সময়ে আঙুল নেড়ে জানালে কাছে আসতে।

মনে হল কম সাহস নয়;

বসলুম ওর এক-বেঞ্চিতে।

গাড়ির আওয়াজের আড়ালে

বললে মৃদুস্বরে,

কিছু মনে কোরো না,

সময় কোথা সময় নষ্ট করবার।

আমাকে নামতে হবে পরের স্টেশনেই;

দূরে যাবে তুমি,

দেখা হবে না আর কোনোদিনই।

তাই যে প্রশ্নটার জবাব এতকাল থেমে আছে,

শুনব তোমার মুখে।

সত্য করে বলবে তো?

আমি বললেম, বলব।

বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়েই শুধোল,

আমাদের গেছে যে দিন

একেবারেই কি গেছে,

কিছুই কি নেই বাকি।

একটুকু রইলেম চুপ করে;

তারপর বললেম,

রাতের সব তারাই আছে

দিনের আলোর গভীরে।

খটকা লাগল, কী জানি বানিয়ে বললেম না কি।

ও বললে, থাক্‌, এখন যাও ও দিকে।

সবাই নেমে গেল পরের স্টেশনে;

আমি চললেম একা।


হার মানা হার পরাব তোমার গলে

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

হার-মানা হার পরাব তোমার গলে।

দূরে রব কত আপন বলের ছলে।

জানি আমি জানি ভেসে যাবে অভিমান,

নিবিড় ব্যথায় ফাটিয়া পড়িবে প্রাণ,

শূন্য হিয়ার বাঁশিতে বাজিবে গান,

পাষান তখন গলিবে নয়নজলে।

শতদল-দল খুলে যাবে থরে থরে

লুকানো রবে না মধু চিরদিনতরে।

আকাশ জুড়িয়া চাহিবে কাহার আঁখি,

ঘরের বাহিরে নীরবে লইবে ডাকি,

কিছুই সেদিন কিছুই রবে না বাকি

পরম মরণ লভিব চরণতলে।


শেষ বসন্ত

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আজিকার দিন না ফুরাতে

হবে মোর এ আশা পুরাতে–

শুধু এবারের মতো

বসন্তের ফুল যত

যাব মোরা দুজনে কুড়াতে।

তোমার কাননতলে ফাল্গুন আসিবে বারম্বার,

তাহারি একটি শুধু মাগি আমি দুয়ারে তোমার।

বেলা কবে গিয়াছে বৃথাই

এতকাল ভুলে ছিনু তাই।

হঠাৎ তোমার চোখে

দেখিয়াছি সন্ধ্যালোকে

আমার সময় আর নাই।

তাই আমি একে একে গনিতেছি কৃপণের সম

ব্যাকুল সংকোচভরে বসন্তশেষের দিন মম।

ভয় রাখিয়ো না তুমি মনে!

তোমার বিকচ ফুলবনে

দেরি করিব না মিছে,

ফিরে চাহিব না পিছে

দিনশেষে বিদায়ের ক্ষণে।

চাব না তোমার চোখে

আঁখিজল পাব আশা করি

রাখিবারে চিরদিন স্মৃতিরে করুণারসে ভরি।

ফিরিয়া যেয়ো না, শোনো শোনো,

সূর্য অস্ত যায় নি এখনো।

সময় রয়েছে বাকি;

সময়েরে দিতে ফাঁকি

ভাবনা রেখো না মনে কোনো।

পাতার আড়াল হতে বিকালের আলোটুকু এসে

আরো কিছুখন ধরে ঝলুক

তোমার কালো কেশে।

হাসিয়া মধুর উচ্চহাসে

অকারণ নির্মম উল্লাসে,

বনসরসীর তীরে

ভীরু কাঠবিড়ালিরে

সহসা চকিত কোরো ত্রাসে।

ভুলে-যাওয়া কথাগুলি কানে কানে করায়ে স্মরণ

দিব না মন্থর করি ওই তব চঞ্চল চরণ।

তার পরে যেয়ো তুমি চলে

ঝরা পাতা দ্রুতপদে দোলে,

নীড়ে-ফেরা পাখি যবে

অস্ফুট কাকলিরবে

দিনান্তেরে ক্ষুব্ধ করি তোলে।

বেণুবনচ্ছায়াঘন সন্ধ্যায় তোমার ছবি দূরে

মিলাইবে গোধূলির বাঁশরির সর্বশেষ সুরে।

রাত্রি যবে হবে অন্ধকার

বাতায়নে বসিয়ো তোমার।

সব ছেড়ে যাব, প্রিয়ে,

সমুখের পথ দিয়ে,

ফিরে দেখা হবে না তো আর।

ফেলে দিয়ো ভোরে-

গাঁথা ম্লান মল্লিকার মালাখানি।

সেই হবে স্পর্শ তব, সেই হবে বিদায়ের বাণী।


মেঘের পরে মেঘ জমেছে

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মেঘের পরে মেঘ জমেছে,

আঁধার করে আসে,

আমায় কেন বসিয়ে রাখ

একা দ্বারের পাশে।

কাজের দিনে নানা কাজে

থাকি নানা লোকের মাঝে,

আজ আমি যে বসে আছি

তোমারি আশ্বাসে।

আমায় কেন বসিয়ে রাখ

একা দ্বারের পাশে।

তুমি যদি না দেখা দাও,

কর আমায় হেলা,

কেমন করে কাটে আমার

এমন বাদল-বেলা।

দূরের পানে মেলে আঁখি

কেবল আমি চেয়ে থাকি,

পরান আমার কেঁদে বেড়ায়

দুরন্ত বাতাসে।

আমায় কেন বসিয়ে রাখ

একা দ্বারের পাশে।


ভীরুতা

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

গভীর সুরে গভীর কথা

শুনিয়ে দিতে তোরে

সাহস নাহি পাই।

মনে মনে হাসবি কিনা

বুঝব কেমন করে?

আপনি হেসে তাই

শুনিয়ে দিয়ে যাই-

ঠাট্টা করে ওড়াই সখী,

নিজের কথাটাই।

হাল্কা তুমি কর পাছে

হাল্কা করি ভাই,

আপন ব্যথাটাই।

সত্য কথা সরলভাবে

শুনিয়ে দিতে তোরে

সাহস নাহি পাই।

অবিশ্বাসে হাসবি কিনা

বুঝব কেমন করে?

মিথ্যা ছলে তাই

শুনিয়ে দিয়ে যাই,

উল্টা করে বলি আমি

সহজ কথাটাই।

ব্যর্থ তুমি কর পাছে

ব্যর্থ করি ভাই,

আপন ব্যথাটাই।

সোহাগ-ভরা প্রাণের কথা

শুনিয়ে দিতে তোরে

সাহস নাহি পাই।

সোহাগ ফিরে পাব কিনা

বুঝব কেমন করে?

কঠিন কথা তাই

শুনিয়ে দিয়ে যাই,

গর্বছলে দীর্ঘ করি

নিজের কথাটাই।

ব্যথা পাছে না পাও তুমি

লুকিয়ে রাখি তাই

নিজের ব্যথাটাই।

ইচ্ছা করে নীরব হয়ে

রহিব তোর কাছে,

সাহস নাহি পাই।

মুখের ‘পরে বুকের কথা

উথ্লে ওঠে পাছে

অনেক কথা তাই

শুনিয়ে দিয়ে যাই,

কথার আড়ে আড়াল থাকে

মনের কথাটাই।

তোমায় ব্যথা লাগিয়ে শুধু

জাগিয়ে তুলি ভাই

আপন ব্যথাটাই।

ইচ্ছা করি সুদূরে যাই,

না আসি তোর কাছে।

সাহস নাহি পাই।

তোমার কাছে ভীরুতা মোর

প্রকাশ হয় রে পাছে

কেবল এসে তাই

দেখা দিয়েই যাই,

স্পর্ধাতলে গোপন করি

মনের কথাটাই।

নিত্য তব নেত্রপাতে

জ্বালিয়ে রাখি ভাই,

আপন ব্যথাটাই।


বর্ষার দিনে

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

এমন দিনে তারে বলা যায়

এমন ঘনঘোর বরিষায় –

এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে

তপনহীন ঘন তমসায়।।

সে কথা শুনিবে না কেহ আর,

নিভৃত নির্জন চারি ধার।

দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি,

আকাশে জল ঝরে অনিবার –

জগতে কেহ যেন নাহি আর।।

সমাজ সংসার মিছে সব,

মিছে এ জীবনের কলরব।

কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে

হৃদয় দিয়ে হৃদি-অনুভব –

আঁধারে মিশে গেছে আর সব।।

বলিতে ব্যথিবে না নিজ কান,

চমকি উঠিবে না নিজ প্রাণ।

সে কথা আঁখিনীরে মিশিয়া যাবে ধীরে,

বাদলবায়ে তার অবসান –

সে কথা ছেয়ে দিবে দুটি প্রাণ।।

তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার

নামাতে পারি যদি মনোভার!

শ্রাবণবরিষনে একদা গৃহকোণে

দু কথা বলি যদি কাছে তার

তাহাতে আসে যাবে কিবা কার।।

আছে তো তার পরে বারো মাস –

উঠিবে কত কথা, কত হাস।

আসিবে কত লোক, কত-না দুখশোক,

সে কথা কোনখানে পাবে নাশ –

জগৎ চলে যাবে বারো মাস।।

ব্যাকুল বেগে আজি বহে বায়,

বিজুলি থেকে থেকে চমকায়।

যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে

সে কথা আজি যেন বলা যায়

এমন ঘনঘোর বরিষায়।।


ব্যর্থ

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

যদি প্রেম দিল না প্রাণে

কেন ভোরের আকাশ

ভরে দিলে এমন গানে গানে?

কেন তারার মালা গাঁথা,

কেন ফুলের শয়ন পাতা,

কেন দখিন হাওয়া গোপন

কথা জানায় কানে কানে?

যদি প্রেম দিলে না প্রাণে

কেন আকাশ তবে এমন

চাওয়া চায় এ মুখের পানে?

তবে ক্ষণে ক্ষণে কেন

আমার হৃদয় পাগল হেন,

তরী সেই সাগরে ভাসায়

যাহার কূল সে নাহি জানে?


পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে

পাগল আমার মন জেগে ওঠে।।

চেনাশোনার কোন বাইরে

যেখানে পথ নাই নাই রে

সেখানে অকারণে যায় ছুটে।।

ঘরের মুখে আর কি রে

কোনো দিন সে যাবে ফিরে।

যাবে না, যাবে না–

দেয়াল যত সব গেল টুটে

বৃষ্টি-নেশা-ভরা সন্ধ্যাবেলা

কোন বলরামের আমি চেলা,

আমার স্বপ্ন ঘিরে নাচে মাতাল জুটে–

যত মাতাল জুটে।

যা না চাইবার তাই আজি চাই গো,

যা না পাইবার তাই কোথা পাই গো।

পাব না, পাব না,

মরি অসম্ভবের পায়ে মাথা কুটে।।


নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে

রয়েছ নয়নে নয়নে,

হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে

হৃদয়ে রয়েছ গোপনে।

বাসনা বসে মন অবিরত,

ধায় দশ দিশে পাগলের মতো।

স্থির আঁখি তুমি ক্ষরণে শতত

জাগিছ শয়নে স্বপনে।

সবাই ছেড়েছে নাই যার কেহ

তুমি আছ তার আছে তব কেহ

নিরাশ্রয় জন পথ যার যেও

সেও আছে তব ভবনে।

তুমি ছাড়া কেহ সাথি নাই আর

সমুখে অনন্ত জীবন বিস্তার,

কাল পারাপার করিতেছ পার

কেহ নাহি জানে কেমনে।

জানি শুধু তুমি আছ তাই আছি

তুমি প্রাণময় তাই আমি বাঁচি,

যত পাই তোমায় আরো তত যাচি

যত জানি তত জানি নে।

জানি আমি তোমায় পাবো নিরন্তন

লোক লোকান্তরে যুগ যুগান্তর

তুমি আর আমি, মাঝে কেহ নাই

কোনো বাঁধা নাই ভুবনে।

নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে

রয়েছ নয়নে নয়নে।


ধ্যান

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

নিত্য তোমায় চিত্ত ভরিয়া

স্মরণ করি,

বিশ্ববিহীন বিজনে বসিয়া

বরণ করি;

তুমি আছ মোর জীবন মরণ

হরণ করি।

তোমার পাই নে কূল-

আপনা-মাঝারে আপনার প্রেম

তাহারো পাই নে তুল।

উদয়শিখরে সূর্যের মতো

সমস্ত প্রাণ মম

চাহিয়া রয়েছে নিমেষ-নিহত

একটি নয়ন-সম

অগাধ অপার উদাস দৃষ্টি,

নাহিকো তাহার সীমা।

তুমি যেন ওই আকাশ উদার,

আমি যেন ওই অসীম পাথার,

আকুল করেছে মাঝখানে তার

আনন্দপূর্ণিমা।

তুমি প্রশান্ত চিরনিশিদিন,

আমি অশান্ত বিরামবিহীন

চঞ্চল অনিবার-

যত দূর হেরি দিক্দিগন্তে

তুমি আমি একাকার।


ছল

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তোমারে পাছে সহজে বুঝি

তাই কি এত লীলার ছল-

বাহিরে যবে হাসির ছটা

ভিতরে থাকে আঁখির জল।

বুঝি গো আমি,

বুঝি গো তব ছলনা-

যে কথা তুমি বলিতে চাও

সে কথা তুমি বল না।।

তোমারে পাছে সহজে ধরি

কিছুরই তব কিনারা নাই-

দশের দলে টানি গো পাছে

কিরূপ তুমি, বিমুখ তাই।

বুঝি গো আমি,

বুঝি গো তব ছলনা-

যে পথে তুমি চলিতে চাও

সে পথে তুমি চল না।।

সবার চেয়ে অধিক চাহ,

তাই কি তুমি ফিরিয়া যাও-

হেলার ভরে খেলার মত

ভিক্ষাঝুলি ভাসায়ে দেও?

বুঝেছি আমি,

বুঝেছি তব ছলনা-

সবার যাহে তৃপ্তি হল

তোমার তাহে হল না ।।


কৃষ্ণকলি

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,

কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।

মেঘলাদিনে দেখেছিলেম মাঠে

কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।

ঘোমটা মাথায় ছিলনা তার মোটে,

মুক্তবেণী পিঠের ‘পরে লোটে।

কালো? তা সে যতই কালো হোক,

দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে

ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই,

শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে

কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই।

আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু

শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু।

কালো? তা সে যতই কালো হোক,

দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

পূবে বাতাস এল হঠাত্‍‌ ধেয়ে,

ধানের ক্ষেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ।

আলের ধারে দাঁড়িয়েছিলেম একা,

মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ।

আমার পানে দেখলে কিনা চেয়ে,

আমি জানি আর জানে সেই মেয়ে।

কালো? তা সে যতই কালো হোক,

দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

এমনি করে কাজল কালো মেঘ

জ্যৈষ্ঠ মাসে আসে ঈশান কোণে।

এমনি করে কালো কোমল ছায়া

আষাঢ় মাসে নামে তমাল-বনে।

এমনি করে শ্রাবণ-রজনীতে

হঠাত্‍‌ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে।

কালো? তা সে যতই কালো হোক,

দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,

আর যা বলে বলুক অন্য লোক।

দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে

কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।

মাথার পরে দেয়নি তুলে বাস,

লজ্জা পাবার পায়নি অবকাশ।

কালো? তা সে যতই কালো হোক,

দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।


আহা আজি এই বসন্তে

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আহা, আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে,

এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়,

সখীর হৃদয় কুসুম কোমল –

কার অনাদরে আজি ঝরে যায়!

কেন কাছে আস, কেন মিছে হাস,

কাছে যে আসিত সে তো আসিতে না চায়।

সুখে আছে যারা, সুখে থাক তারা,

সুখের বসন্ত সুখে হোক সারা –

দুখিনী নারীর নয়নের নীর

সুখী জনে যেন দেখিতে না পায়।

তারা দেখেও দেখে না, তারা বুঝেও বুঝে না,

তারা ফিরেও না চায়।


আষাঢ়

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।

ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।

বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর,

আউশের ক্ষেত জলে ভরভর,

কালি-মাখা মেঘে ও পারে আঁধার ঘনিছে দেখ্ চাহি রে।

ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।।

ওই ডাকে শোনো ধেনু ঘনঘন,

ধবলীরে আনো গোহালে।

এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে।

দুয়ারে দাঁড়ায়ে ওগো দেখ্ দেখি

মাঠে গেছে যারা তারা ফিরিছে কি,

রাখালবালক কী জানি কোথায়

সারা দিন আজি খোয়ালে।

এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে।।

শোনো শোনো ওই পারে যাবে বলে

কে ডাকিছে বুঝি মাঝিরে।

খেয়া-পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে।

পুবে হাওয়া বয়, কূলে নেই কেউ,

দু কূল বাহিয়া উঠে পড়ে ঢেউ,

দরদর বেগে জলে পড়ি জল ছলছল উঠে বাজি রে।

খেয়া-পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে।।

ওগো, আজ তোরা যাস নে গো,

তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।

আকাশ আঁধার, বেলা বেশি আর নাহি রে।

ঝরঝর ধারে ভিজিবে নিচোল,

ঘাটে যেতে পথ হয়েছে পিছল,

ওই বেণুবন দুলে ঘনঘন পথপাশে দেখ্ চাহি রে।

ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।।


আমার খেলা যখন ছিল তোমার সনে

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমার খেলা যখন ছিল তোমার সনে

তখন কে তুমি তা কে জানত।

তখন ছিল না ভয়, ছিল না লাজ মনে,

জীবন বহে যেত অশান্ত।

তুমি ভোরের বেলা ডাক দিয়েছ কত

যেন আমার আপন সখার মতো,

হেসে তোমার সাথে ফিরেছিলাম ছুটে

সেদিন কত-না বন-বনান্ত।

ওগো, সেদিন তুমি গাইতে যে সব গান

কোনো অর্থ তাহার কে জানত।

শুধু সঙ্গে তারি গাইত আমার প্রাণ,

সদা নাচত হৃদয় অশান্ত।

হঠাৎ খেলার শেষে আজ কী দেখি ছবি –

স্তব্ধ আকাশ, নীরব শশী রবি,

তোমার চরণপানে নয়ন করি নত

ভুবন দাঁড়িয়ে গেছে একান্ত।


আমার মাঝে তোমার লীলা হবে

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমার মাঝে তোমার লীলা হবে,

তাই তো আমি এসেছি এই ভবে।

এই ঘরে সব খুলে যাবে দ্বার,

ঘুচে যাবে সকল অহংকার,

আনন্দময় তোমার এ সংসার

আমার কিছু আর বাকি না রবে।

মরে গিয়ে বাঁচব আমি, তবে

আমার মাঝে তোমার লীলা হবে।

সব বাসনা যাবে আমার থেমে

মিলে গিয়ে তোমারি এক প্রেমে,

দুঃখসুখের বিচিত্র জীবনে

তুমি ছাড়া আর কিছু না রবে।


আমার এ প্রেম নয় তো ভীরু

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমার এ প্রেম নয় তো ভীরু,

নয় তো হীনবল-

শুধু কি এ ব্যাকুল হয়ে

ফেলবে অশ্রুজল।

মন্দমধুর সুখে শোভায়

প্রেম কে কেন ঘুমে ডোবায়।

তোমার সাথে জাগতে সে চায়

আনন্দে পাগল।

নাচ যখন ভীষণ সাজে

তীব্র তালের আঘাত বাজে,

পালায় ত্রাসে পালায় লাজে

সন্দেহ বিহবল।

সেই প্রচন্ড মনোহরে

প্রেম যেন মোর বরণ করে,

ক্ষুদ্র আশার স্বর্গ তাহার

দিক সে রসাতল।


আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার,

পরানসখা বন্ধু হে আমার।

আকাশ কাঁদে হতাশ-সম,

নাই যে ঘুম নয়নে মম,

দুয়ার খুলি হে প্রিয়তম,

চাই যে বারে বার।

পরানসখা বন্ধু হে আমার।

বাহিরে কিছু দেখিতে নাহি পাই,

তোমার পথ কোথায় ভাবি তাই।

সুদূর কোন্‌ নদীর পারে,

গহন কোন্‌ অন্ধকারে

হতেছ তুমি পার।

পরানসখা বন্ধু হে আমার।


আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।

তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে

কোরো না বিড়ম্বিত তারে।

আজি খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো,

আজি ভুলিয়ো আপনপর ভুলিয়ো,

এই সংগীত মুখরিত গগনে

তব গন্ধ তরঙ্গিয়া তুলিয়ো।

এই বাহির ভুবনে দিশা হারায়ে

দিয়ো ছড়ায়ে মাধুরী ভারে ভারে।

অতি নিবিড় বেদনা বনমাঝে রে

আজি পল্লবে পল্লবে বাজে রে-

দূরে গগনে কাহার পথ চাহিয়া

আজি ব্যাকুল বসুন্ধরা সাজে রে।

মোর পরানে দখিন বায়ু লাগিছে,

কারে দ্বারে দ্বারে কর হানি মাগিছে,

এই সৌরভবিহ্বল রজনী

কার চরণে ধরণীতলে জাগিছে।

ওগো সুন্দর, বল্লভ, কান্ত,

তব গম্ভীর আহ্বান কারে।

1 thought on “Rabindranath Thakur Kobita List  – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা”

Comments are closed.