Bangla Premer Kobita – বাংলা প্রেমের কবিতা

WhatsApp Group Join Now
Instagram Profile Join Now
Telegram Channel Join Now

Bangla Premer Kobita

বাংলা প্রেমের কবিতার লিস্ট

Bangla Premer Kobita মধ্যে কিছু জনপ্রিয় কবিতা গুলি নিচে বিস্তারিত দেউয়া হল আপনরা খুব সহজে কবিতা গুলিকে পড়তে পারবেন এবং আপনাদের সুবিধার্তে নিচে আরো কবিতা সমগ্র নিয়ে আলোচনা করা করা হল । আরো নিয়মিত কবিতা এছাড়া GK পিডিএফ , সরকারী চাকরির খবর আপডেট পেতে বেলবাটনে ক্লিক করে রাখবেন।

Bengali PoemClick Here
Bangla Premer KobitaClick Here
Bangla Romantic KobitaClick Here
Bangla Sad KobitaClick Here
Bangla Love KobitaClick Here
Rabindranath Thakur Kobita List  Click Here

অনন্ত প্রেম

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শতবার

জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।

চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয় গাঁথিয়াছে গীতহার–

কত রূপ ধরে পরেছ গলায়, নিয়েছ সে উপহার

জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।

যত শুনি সেই অতীত কাহিনী, প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,

অতি পুরাতন বিরহমিলন কথা,

অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে দেখা দেয় অবশেষে

কালের তিমিররজনী ভেদিয়া তোমারি মুরতি এসে

চিরস্মৃতিময়ী ধ্রুবতারকার বেশে।

আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগলপ্রেমের স্রোতে

অনাদি কালের হৃদয়-উৎস হতে।

আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা কোটি প্রেমিকের মাঝে

বিরহবিধুর নয়নসলিলে, মিলনমধুর লাজে–

পুরাতন প্রেম নিত্যনূতন সাজে।

আজি সেই চির-দিবসের প্রেম অবসান লভিয়াছে,

রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে।

নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ, নিখিল প্রাণের প্রীতি,

একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে সকল প্রেমের স্মৃতি–

সকল কালের সকল কবির গীতি।


অ নামিকা

– কাজী নজরুল ইসলাম

তোমারে বন্দনা করি স্বপ্ন-সহচরী

লো আমার অনাগত প্রিয়া,

আমার পাওয়ার বুকে না-পাওয়ার তৃষ্ণা-জাগানিয়া!

তোমারে বন্দনা করি…

হে আমার মানস-রঙ্গিণী,

অনন্ত-যৌবনা বালা, চিরন্তন বাসনা-সঙ্গিনী!

তোমারে বন্দনা করি…

নাম-নাহি-জানা ওগো আজো-নাহি-আসা!

আমার বন্দনা লহ, লহ ভালবাসা…

গোপণ-চারিণী মোর, লো চির-প্রেয়সী!

সৃষ্টি-দিন হতে কাঁদ’ বাসনার অন্তরালে বসি’-

ধরা নাহি দিলে দেহে।

তোমার কল্যাণ-দীপ জ্বলিলে না

দীপ-নেভা বেড়া-দেওয়া গেহে।

অসীমা! এলে না তুমি সীমারেখা-পারে!

স্বপনে পাইয়া তোমা স্বপনে হারাই বারে বারে

অরুপা লো! রহি হয়ে এলে মনে,

সতী হয়ে এলে না ক ঘরে।

প্রিয় হয়ে এলে প্রেমে,

বধূ হয়ে এলে না অধরে!

দ্রাক্ষা-বুকে রহিলে গোপনে তুমি শিরীন্‌ শরাব,

পেয়ালায় নাহি এলে!-

‘উতারো নেকার’-

হাঁকে মোর দুরন্ত কামনা!

সুদুরিকা! দূরে থাক’-ভালোবাসা-নিকটে এসো না।

তুমি নহ নিভে যাওয়া আলো, নহ শিখা।

তুমি মরীচিকা,

তুমি জ্যোতি।-

জন্ম-জন্মান্তর ধরি’ লোকে-লোকান্তরে তোমা’ করেছি আরতি,

বারে বারে একই জন্মে শতবার করি!

যেখানে দেখেছি রূপ,-করেছি বন্দনা প্রিয়া তোমারেই স্মরি’।

রূপে রূপে, অপরূপা, খুঁজেছি তোমায়,

পবনের যবনিকা যত তুলি তত বেড়ে যায়!

বিরহের কান্না-ধোওয়া তৃপ্ত হিয়া ভরি’

বারে বারে উদিয়াছ ইন্দ্রধনুসমা,

হাওয়া-পরী

প্রিয় মনোরমা!

ধরিতে গিয়োছি-তুমি মিলায়েছ দূর দিগ্বলয়ে

ব্যথা-দেওয়া রাণী মোর, এলে না ক কথা কওয়া হয়ে।

চির-দূরে থাকা ওগো চির-নাহি-আসা!

তোমারে দেহের তীরে পাবার দুরাশা

গ্রহ হতে গ্রহান্তরে লয়ে যায় মোরে!

বাসনার বিপুল আগ্রহে-

জন্ম লভি লোকে-লোকান্তরে!

উদ্বেলিত বুকে মোর অতৃপ্ত যৌবন-ক্ষুধা

উদগ্র কামনা,

জন্ম তাই লভি বারে বারে,

না-পাওয়ার করি আরাধনা!…

যা-কিছু সুন্দর হেরি’ করেছি চুম্বন,

যা-কিছু চুম্বন দিয়া করেছি সুন্দর-

সে-সবার মাঝে যেন তব হরষণ

অনুভব করিয়াছি!-ছুঁয়েছি অধর

তিলোত্তমা, তিলে তিলে!

তোমারে যে করেছি চুম্বন

প্রতি তরুণীর ঠোঁটে

প্রকাশ গোপন।

যে কেহ প্রিয়ারে তার চুম্বিয়াছে ঘুম-ভাঙা রাতে,

রাত্রি-জাগা তন্দ্রা-লাগা ঘুম-পাওয়া প্রাতে,

সকলের সাথে আমি চুমিয়াছি তোমা’

সকলের ঠোঁটে যেন, হে নিখিল-প্রিয়া প্রিয়তমা!

তরু, লতা, পশু, পাখী, সকলের কামনার সাথে

আমার কামনা জাগে,-আমি রমি বিশ্ব-কামনাতে!

বঞ্চিত যাহারা প্রেমে, ভুঞ্জে যারা রতি-

সকলের মাঝে আমি-সকলের প্রেমে মোর গতি!

যে-দিন স্রষ্টার বুকে জেগেছিল আদি সৃষ্টি-কাম,

সেই দিন স্রষ্টা সাথে তুমি এলে, আমি আসিলাম।

আমি কাম, তুমি হলে রতি,

তরুণ-তরুণী বুকে নিত্য তাই আমাদের অপরূপ গতি!

কী যে তুমি, কী যে নহ, কত ভাবি-কত দিকে চাই!

নামে নামে, অ-নামিকা, তোমারে কি খুঁজিনু বৃথাই?

বৃথাই বাসিনু ভালো? বৃথা সবে ভালোবাসে মোরে?

তুমি ভেবে যারে বুকে চেপে ধরি সে-ই যায় সরে।

কেন হেন হয়, হায়, কেন লয় মনে-

যারে ভালো বাসিলাম, তারো চেয়ে ভালো কেহ

বাসিছে গোপনে।

সে বুঝি সুন্দরতর-আরো আরো মধু!

আমারি বধূর বুকে হাসো তুমি হয়ে নববধূ।

বুকে যারে পাই, হায়,

তারি বুকে তাহারি শয্যায়

নাহি-পাওয়া হয়ে তুমি কাঁদ একাকিনী,

ওগো মোর প্রিয়ার সতিনী।…

বারে বারে পাইলাম-বারে বারে মন যেন কহে-

নহে, এ সে নহে!

কুহেলিকা! কোথা তুমি? দেখা পাব কবে?

জন্মেছিলে জন্মিয়াছ কিম্বা জন্ম লবে?

কথা কও, কও কথা প্রিয়া,

হে আমার যুগে-যুগে না-পাওয়ার তৃষ্ণা-জাগানিয়া!

কহিবে না কথা তুমি! আজ মনে হয়,

প্রেম সত্য চিরন্তন, প্রেমের পাত্র সে বুঝি চিরন্তন নয়।

জন্ম যার কামনার বীজে

কামনারই মাঝে সে যে বেড়ে যায় কল্পতরু নিজে।

দিকে দিকে শাখা তার করে অভিযান,

ও যেন শুষিয়া নেবে আকাশের যত বায়ু প্রাণ।

আকাশ ঢেকেছে তার পাখা

কামনার সবুজ বলাকা!

প্রেম সত্য, প্রেম-পাত্র বহু-আগণন,

তাই-চাই, বুকে পাই, তবু কেন কেঁদে ওঠে মন।

মদ সত্য, পাত্র সত্য নয়!

যে-পাত্রে ঢালিয়া খাও সেই নেশা হয়!

চির-সহচরী!

এতদিনে পরিচয় পেনু, মরি মরি!

আমারি প্রেমের মাঝে রয়েছ গোপন,

বৃথা আমি খুঁজে মরি’ জন্মে জন্মে করিনু রোদন।

প্রতি রূপে, অপরূপা, ডাক তুমি,

চিনেছি তোমায়,

যাহারে বাসিব ভালো-সে-ই তুমি,

ধরা দেবে তায়!

প্রেম এক, প্রেমিকা সে বহু,

বহু পাত্রে ঢেলে পিব সেই প্রেম-

সে শরাব লোহু।

তোমারে করিব পান, অ-নামিকা, শত কামনায়,

ভৃঙ্গারে, গোলাসে কভু, কভু পেয়ালায়!


হৃদয়ে প্রেমের দিন

– জীবনানন্দ দাশ

হৃদয়ে প্রেমের দিন কখন যে শেষ হয়-

চিতা শুধু পড়ে থাকে তার,

আমরা জানি না তাহা;

মনে হয় জীবনে যা আছে আজো তাই শালিধান

রূপশালি ধান তাহা… রূপ, প্রেম… এই ভাবি…

খোসার মতন নষ্ট ম্লান

একদিন তাহাদের অসারতা ধরা পড়ে,

যখন সবুজ অন্ধকার,

নরম রাত্রির দেশ নদীর জলের গন্ধ

কোন এক নবীনাগতার

মুখখানা নিয়ে আসে-

মনে হয় কোনোদিন পৃথিবীতে প্রেমের আহ্বান

এমন গভীর করে পেয়েছি কি?

প্রেম যে নক্ষত্র আর নক্ষত্রের গান,

প্রাণ যে ব্যাকুল রাত্রি প্রান্তরের গাঢ় নীল অমাবস্যায়-

চলে যায় আকাশের সেই দূর

নক্ষত্রের লাল নীল শিখার সন্ধানে,

প্রাণ যে আঁধার রাত্রি আমার এ,

আর তুমি স্বাতীর মতন

রূপের বিচিত্র বাতি নিয়ে এলে,

তাই প্রেম ধুলায় কাঁটায় যেইখানে

মৃত হয়ে পড়ে ছিল পৃথিবীর শূণ্য পথে

সে গভীর শিহরণ,

তুমি সখী, ডুবে যাবে মুহূর্তেই রোমহর্ষে-

অনিবার অরুণের ম্লানে

জানি আমি; প্রেম যে তবুও প্রেম;

স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে রবে, বাঁচিতে সে জানে।


কৃষ্ণকলি

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,

কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।

মেঘলাদিনে দেখেছিলেম মাঠে

কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।

ঘোমটা মাথায় ছিলনা তার মোটে,

মুক্তবেণী পিঠের ‘পরে লোটে।

কালো? তা সে যতই কালো হোক,

দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে

ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই,

শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে

কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই।

আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু

শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু।

কালো? তা সে যতই কালো হোক,

দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

পূবে বাতাস এল হঠাত্‍‌ ধেয়ে,

ধানের ক্ষেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ।

আলের ধারে দাঁড়িয়েছিলেম একা,

মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ।

আমার পানে দেখলে কিনা চেয়ে,

আমি জানি আর জানে সেই মেয়ে।

কালো? তা সে যতই কালো হোক,

দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

এমনি করে কাজল কালো মেঘ

জ্যৈষ্ঠ মাসে আসে ঈশান কোণে।

এমনি করে কালো কোমল ছায়া

আষাঢ় মাসে নামে তমাল-বনে।

এমনি করে শ্রাবণ-রজনীতে

হঠাত্‍‌ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে।

কালো? তা সে যতই কালো হোক,

দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,

আর যা বলে বলুক অন্য লোক।

দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে

কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।

মাথার পরে দেয়নি তুলে বাস,

লজ্জা পাবার পায়নি অবকাশ।

কালো? তা সে যতই কালো হোক,

দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।


অগ্ন্যুৎসব

– হেলাল হাফিজ

ছিল তা এক অগ্ন্যুৎসব, সেদিন আমি

সবটুকু বুক রেখেছিলাম স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রে

জীবন বাজি ধরেছিলাম প্রেমের নামে

রক্ত ঋণে স্বদেশ হলো,

তোমার দিকে চোখ ছিলো না

জন্মভূমি সেদিন তোমার সতীন ছিলো।

আজকে আবার জীবন আমার ভিন্ন স্বপ্নে অংকুরিত অগ্ন্যুৎসবে

তোমাকে চায় শুধুই তোমায়।

রঙিন শাড়ির হলুদ পাড়ে ঋতুর প্লাবন নষ্ট করে

ভর দুপুরে শুধুই কেন হাত বেঁধেছো বুক ঢেকেছো

যুঁই চামেলী বেলীর মালায়,

আমার বুকে সেদিন যেমন আগুন ছিলো

ভিন্নভাবে জ্বলছে আজও,

তবু সবই ব্যর্থ হবে

তুমি কেবল যুঁই চামেলী বেলী ফুলেই মগ্ন হলে।

তার চেয়ে আজ এসো দু’জন জাহিদুরের গানের মতন

হৃদয় দিয়ে বোশেখ ডাকি, দু’জীবনেই বোশেখ আনি।

জানো হেলেন, আগুন দিয়ে হোলি খেলায় দারুন আরাম

খেলবো দু’জন এই শপথে

এসো স্ব-কাল শুদ্ধ করি দুর্বিনীত যৌবনেরে।


অবেলার ডাক

– কাজী নজরুল ইসলাম

অনেক করে বাসতে ভালো পারিনি মা তখন যারে, 

আজ অবেলায় তারেই মনে পড়ছে কেন বারে বারে।। 

আজ মনে হয় রোজ রাতে সে ঘুম পাড়াত নয়ন চুমে, 

চুমুর পরে চুম দিয়ে ফের হান্‌তে আঘাত ভোরের ঘুমে। 

ভাব্‌তুম তখন এ কোন্‌ বালাই! 

কর্‌ত এ প্রাণ পালাই পালাই। 

আজ সে কথা মনে হয়ে ভাসি অঝোর নয়ন-ঝরে। 

অভাগিনীর সে গরব আজ ধূলায় লুটায় ব্যথার ভারে।।

তরুণ তাহার ভরাট বুকের উপ্‌চে-পড়া আদর সোহাগ 

হেলায় দু’পায় দলেছি মা, আজ কেন হায় তার অনুরাগ? 

এই চরণ সে বক্ষে চেপে 

চুমেছে, আর দু’চোখ ছেপে 

জল ঝরেছে, তখনো মা কইনি কথা অহঙ্কারে, 

এম্‌নি দারুণ হতাদরে করেছি মা, বিদায় তারে।।

দেখেওছিলাম বুক-ভরা তার অনাদরের আঘাত-কাঁটা, 

দ্বার হতে সে গেছে দ্বারে খেয়ে সবার লাথি-ঝাটা। 

ভেবেছিলাম আমার কাছে 

তার দরদের শানি- আছে, 

আমিও গো মা ফিরিয়ে দিলাম চিন্‌তে নেরে দেবতারে। 

ভিক্ষুবেশে এসেছিল রাজাধিরাজ দাসীর দ্বারে।।

পথ ভুলে সে এসেছিল সে মোর সাধের রাজ-ভিখারী, 

মাগো আমি ভিখারিনী, আমি কি তাঁয় চিন্‌তে পারি? 

তাই মাগো তাঁর পূজার ডালা 

নিইনি, নিইনি মণির মালা, 

দেব্‌তা আমার নিজে আমায় পূজল ষোড়শ-উপচারে। 

পূজারীকে চিন্‌লাম না মা পূজা-ধূমের অন্ধকারে।।

আমায় চাওয়াই শেষ চাওয়া তার মাগো আমি তা কি জানি? 

ধরায় শুধু রইল ধরা রাজ-অতিথির বিদায়-বাণী। 

ওরে আমার ভালোবাসা! 

কোথায় বেঁধেছিলি বাসা 

যখন আমার রাজা এসে দাঁড়িয়েছিল এই দুয়ারে? 

নিঃশ্বসিয়া উঠছে ধরা, ‘নেই রে সে নেই, খুঁজিস কারে!’

সে যে পথের চির-পথিক, তার কি সহে ঘরের মায়া? 

দূর হতে মা দূরন-রে ডাকে তাকে পথের ছায়া। 

মাঠের পারে বনের মাঝে 

চপল তাহার নূপুর বাজে, 

ফুলের সাথে ফুটে বেড়ায়, মেঘের সাথে যায় পাহাড়ে, 

ধরা দিয়েও দেয় না ধরা জানি না সে চায় কাহারে?

মাগো আমায় শক্তি কোথায় পথ-পাগলে ধরে রাখার? 

তার তরে নয় ভালোবাসা সন্ধ্যা-প্রদীপ ঘরে ডাকার। 

তাই মা আমার বুকের কবাট 

খুলতে নারল তার করাঘাত, 

এ মন তখন কেমন যেন বাসত ভালো আর কাহারে, 

আমিই দূরে ঠেলে দিলাম অভিমানী ঘর-হারারে।।

সোহাগে সে ধরতে যেত নিবিড় করে বক্ষে চেপে, 

হতভাগী পারিয়ে যেতাম ভয়ে এ বুক উঠ্‌ত কেঁপে। 

রাজ ভিখারীর আঁখির কালো, 

দূরে থেকেই লাগ্‌ত ভালো, 

আসলে কাছে ক্ষুধিত তার দীঘল চাওয়া অশ্র”-ভারে। 

ব্যথায় কেমন মুষড়ে যেতাম, সুর হারাতাম মনে তরে।।

আজ কেন মা তারই মতন আমারো এই বুকের ক্ষুধা 

চায় শুধু সেই হেলায় হারা আদর-সোহাগ পরশ-সুধা, 

আজ মনে হয় তাঁর সে বুকে 

এ মুখ চেপে নিবিড় সুখে 

গভীর দুখের কাঁদন কেঁদে শেষ করে দিই এ আমারে! 

যায় না কি মা আমার কাঁদন তাঁহার দেশের কানন-পারে?

আজ বুঝেছি এ-জনমের আমার নিখিল শানি–আরাম 

চুরি করে পালিয়ে গেছে চোরের রাজা সেই প্রাণারাম।

হে বসনে-র রাজা আমার!

নাও এসে মোর হার-মানা-হারা!

আজ যে আমার বুক ফেটে যায় আর্তনাদের হাহাকারে, 

দেখে যাও আজ সেই পাষাণী কেমন করে কাঁদতে পারে!

তোমার কথাই সত্য হল পাষাণ ফেটেও রক্ত বহে, 

দাবাললের দারণ দাহ তুষার-গিরি আজকে দহে। 

জাগল বুকে ভীষণ জোয়ার, 

ভাঙল আগল ভাঙল দুয়ার 

মূকের বুকে দেব্‌তা এলেন মুখর মুখে ভীম পাথারে। 

বুক ফেটেছে মুখ ফুটেছে-মাগো মানা কর্‌ছ কারে?

স্বর্গ আমার গেছে পুড়ে তারই চলে যাওয়ার সাথে, 

এখন আমার একার বাসার দোসরহীন এই দুঃখ-রাতে। 

ঘুম ভাঙাতে আস্‌বে না সে 

ভোর না হতেই শিয়র-পাশে, 

আস্‌বে না আর গভীর রাতে চুম-চুরির অভিসারে, 

কাঁদাবে ফিরে তাঁহার সাথী ঝড়ের রাতি বনের পারে।

আজ পেলে তাঁয় হুম্‌ড়ি খেয়ে পড়তুম মাগো যুগল পদে, 

বুকে ধরে পদ-কোকনদ স্নান করাতাম আঁখির হ্রদে। 

বসতে দিতাম আধেক আঁচল, 

সজল চোখের চোখ-ভরা জল- 

ভেজা কাজল মুছতাম তার চোখে মুখে অধর-ধারে, 

আকুল কেশে পা মুছাতাম বেঁধে বাহুর কারাগারে।

দেখ্‌তে মাগো তখন তোমার রাক্ষুসী এই সর্বনাশী, 

মুখ থুয়ে তাঁর উদার বুকে বলত, ‘আমি ভালোবাসি!’ 

বল্‌তে গিয়ে সুখ-শরমে 

লাল হয়ে গাল উঠত ঘেমে, 

বুক হতে মুখ আস্‌ত নেমে লুটিয়ে যখন কোল-কিনারে, 

দেখ্‌তুম মাগো তখন কেমন মান করে সে থাক্‌তে পারে!

এম্‌নি এখন কতই আমা ভালোবাসার তৃষ্ণা জাগে 

তাঁর ওপর মা অভিমানে, ব্যাথায়, রাগে, অনুরাগে। 

চোখের জলের ঋণী করে, 

সে গেছে কোন্‌ দ্বীপান-রে? 

সে বুঝি মা সাত সমুদ্দুর তের নদীর সুদূরপারে? 

ঝড়ের হাওয়া সেও বুঝি মা সে দূর-দেশে যেতে নারে?

তারে আমি ভালোবাসি সে যদি তা পায় মা খবর, 

চৌচির হয়ে পড়বে ফেটে আনন্দে মা তাহার কবর। 

চীৎকারে তার উঠবে কেঁপে 

ধরার সাগর অশ্রু ছেপে, 

উঠবে ক্ষেপে অগ্নি-গিরি সেই পাগলের হুহুঙ্কারে, 

ভূধর সাগর আকাশ বাতাস ঘুর্ণি নেচে ঘিরবে তারে।

ছি, মা! তুমি ডুকরে কেন উঠছ কেঁদে অমন করে? 

তার চেয়ে মা তারই কোনো শোনা-কথা শুনাও মোরে! 

শুনতে শুনতে তোমার কোলে 

ঘুমিয়ে পড়ি। – ও কে খোলে 

দুয়ার ওমা? ঝড় বুঝি মা তারই মতো ধাক্কা মারে? 

ঝোড়ো হওয়া! ঝোড়ো হাওয়া! বন্ধু তোমার সাগর পারে!

সে কি হেথায় আসতে পারে আমি যেথায় আছি বেঁচে, 

যে দেশে নেই আমার ছায়া এবার সে সেই দেশে গেছে! 

তবু কেন থাকি থাকি, 

ইচ্ছা করে তারেই ডাকি! 

যে কথা মোর রইল বাকী হায় সে কথা শুনাই কারে? 

মাগো আমার প্রাণের কাঁদন আছড়ে মরে বুকের দ্বারে!

যাই তবে মা! দেখা হলে আমার কথা বলো তারে- 

রাজার পূজা-সে কি কভু ভিখারিনী ঠেলতে পারে? 

মাগো আমি জানি জানি, 

আসবে আবার অভিমানী 

খুঁজতে আমায় গভীর রাতে এই আমাদের কুটীর-দ্বারে, 

বলো তখন খুঁজতে তারেই হারিয়ে গেছি অন্ধকারে!


আমি খুব অল্প কিছু চাই

– হুমায়ূন আহমেদ

আমাকে ভালবাসতে হবে না,

ভালবাসি বলতে হবে না।

মাঝে মাঝে গভীর আবেগ

নিয়ে আমার ঠোঁট

দুটো ছুয়ে দিতে হবে না।

কিংবা আমার জন্য রাত

জাগা পাখিও

হতে হবে না।

অন্য সবার মত আমার

সাথে রুটিন মেনে দেখা করতে হবে না।

কিংবা বিকেল বেলায় ফুচকাও

খেতে হবে না।

এত অসীম সংখ্যক “না” এর ভিড়ে

শুধু মাত্র একটা কাজ

করতে হবে 

আমি যখন

প্রতিদিন এক বার “ভালবাসি” বলব 

তুমি প্রতিবার

একটা দীর্ঘশ্বাস

ফেলে একটু

খানি আদর মাখা

গলায় বলবে “পাগলি”।


আমি যদি হতাম

– জীবনানন্দ দাশ

আমি যদি হতাম বনহংস,

বনহংসী হতে যদি তুমি;

কোনো এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে

ধানক্ষেতের কাছে

ছিপছিপে শরের ভিতর

এক নিরালা নীড়ে;

তাহলে আজ এই ফাল্গুনের রাতে

ঝাউয়ের শাখার পেছনে চাঁদ উঠতে দেখে

আমরা নিম্নভূমির জলের গন্ধ ছেড়ে

আকাশের রুপালি শস্যের ভিতর গা ভাসিয়ে দিতাম-

তোমার পাখনায় আমার পালক,

আমার পাখনায় তোমার রক্তের স্পন্দন-

নীল আকাশে খইক্ষেতের সোনালি ফুলের মতো অজস্র তারা,

শিরীষ বনের সবুজ রোমশ নীড়ে

সোনার ডিমের মতো

ফাল্গুনের চাঁদ।

হয়তো গুলির শব্দঃ

আমাদের তির্যক গতিস্রোত,

আমাদের পাখায় পিস্টনের উল্লাস,

আমাদের কন্ঠে উত্তর হাওয়ার গান!

হয়তো গুলির শব্দ আবারঃ

আমাদের স্তব্ধতা,

আমাদের শান্তি।

আজকের জীবনের এই টুকরো টুকরো

মৃত্যু আর থাকত না:

থাকত না আজকের জীবনের টুকরো টুকরো

সাধের ব্যর্থতা ও অন্ধকার;

আমি যদি বনহংস হতাম,

বনহংসী হতে যদি তুমি;

কোনো এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে

ধানক্ষেতের কাছে ।


আকাশলীনা

– জীবনানন্দ দাশ

সুরঞ্জনা, ঐখানে যেয়ো নাকো তুমি,

বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে;

ফিরে এসো সুরঞ্জনা

নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;

ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;

ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;

দূর থেকে দূরে – আরও দূরে

যুবকের সাথে তুমি যেয়ো নাকো আর।

কী কথা তাহার সাথে? – তার সাথে!

আকাশের আড়ালে আকাশে

মৃত্তিকার মতো তুমি আজ

তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।

সুরঞ্জনা, তোমার হৃদয় আজ ঘাস;

বাতাসের ওপারে বাতাস –

আকাশের ওপারে আকাশ।


কথোপকথন ১১

– পুর্ণেন্দু পত্রী

– তুমি আজকাল বড্ড সিগারেট খাচ্ছ শুভঙ্কর।

– এখুনি ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছি।

কিন্তু তার বদলে?

– বড্ড হ্যাংলা। যেন খাওনি কখনো?

– খেয়েছি।

কিন্তু আমার খিদের কাছে সে সব নস্যি।

কলকাতাকে এক খাবলায় চিবিয়ে খেতে পারি আমি,

আকাশটাকে ওমলেটের মতো চিরে চিরে,

নক্ষত্রগুলোকে চিনেবাদামের মতো টুকটাক করে,

পাহাড়গুলোকে পাঁপর ভাজার মতো মড়মড়িয়ে,

আর গঙ্গা?

সে তো এক গ্লাস সরবত।

– থাক। খুব বীরপুরুষ।

– সত্যি তাই।

পৃথিবীর কাছে আমি এই রকমই ভয়ংকর বিস্ফোরণ।

কেবল তোমার কাছে এলেই দুধের বালক,

কেবল তোমার কাছে এলেই ফুটপাতের নুলো ভিখারি,

এক পয়সা, আধ পয়সা কিংবা এক টুকরো পাউরুটির বেশী

আর কিছু ছিনিয়ে নিতে পারিনা।

– মিথ্যুক।

– কেন?

– সেদিন আমার সর্বাঙ্গের শাড়ি ধরে টান মারনি?

– হতে পারে।

ভিখারিদের কি ডাকাত হতে ইচ্ছে করবে না একদিনও??


পাগলী, তোমার সঙ্গে

জয় গোস্বামী

পাগলী, তোমার সঙ্গে ভয়াবহ জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোবালি কাটাব জীবন

এর চোখে ধাঁধা করব, ওর জল করে দেব কাদা

পাগলী, তোমার সঙ্গে ঢেউ খেলতে যাব দু’কদম।

অশান্তি চরমে তুলব, কাকচিল বসবে না বাড়িতে

তুমি ছুঁড়বে থালা বাটি, আমি ভাঙব কাঁচের বাসন

পাগলী, তোমার সঙ্গে বঙ্গভঙ্গ জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে ৪২ কাটাব জীবন।

মেঘে মেঘে বেলা বাড়বে, ধনে পুত্রে লক্ষ্মী লোকসান

লোকাসান পুষিয়ে তুমি রাঁধবে মায়া প্রপন্ঞ্চ ব্যন্জ্ঞন

পাগলী, তোমার সঙ্গে দশকর্ম জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে দিবানিদ্রা কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার সঙ্গে ঝোলভাত জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে মাংসরুটি কাটাব জীবন

পাগলী, তোমার সঙ্গে নিরক্ষর জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে চার অক্ষর কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার সঙ্গে বই দেখব প্যারামাউন্ট হলে

মাঝে মাঝে মুখ বদলে একাডেমি রবীন্দ্রসদন

পাগলী, তোমার সঙ্গে নাইট্যশালা জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে কলাকেন্দ্র কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার সঙ্গে বাবুঘাট জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে দেশপ্রিয় কাটাব জীবন

পাগলী, তোমার সঙ্গে সদা সত্য জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে ‘কী মিথ্যুক’ কাটাব জীবন।

এক হাতে উপায় করব, দুহাতে উড়িয়ে দেবে তুমি

রেস খেলব জুয়া ধরব ধারে কাটাব সহস্র রকম

লটারি, তোমার সঙ্গে ধনলক্ষ্মী জীবন কাটাব

লটারি, তোমার সঙ্গে মেঘধন কাটাব জীবন।

দেখতে দেখতে পুজো আসবে, দুনিয়া চিত্‍কার করবে সেল

দোকানে দোকানে খুঁজব রূপসাগরে অরূপরতন

পাগলী, তোমার সঙ্গে পুজোসংখ্যা জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে রিডাকশনে কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার সঙ্গে কাঁচা প্রুফ জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে ফুলপেজ কাটাব জীবন

পাগলী, তোমার সঙ্গে লে আউট জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে লে হালুয়া কাটাব জীবন।

কবিত্ব ফুড়ুত্‍ করবে, পিছু পিছু ছুটব না হা করে

বাড়ি ফিরে লিখে ফেলব বড়ো গল্প উপন্যাসোপম

পাগলী, তোমার সঙ্গে কথাশিল্প জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে বকবকম কাটাব জীবন।

নতুন মেয়ের সঙ্গে দেখা করব লুকিয়ে চুরিয়ে

ধরা পড়ব তোমার হাতে, বাড়ি ফিরে হেনস্তা চরম

পাগলী, তোমার সঙ্গে ভ্যাবাচ্যাকা জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে হেস্তনেস্ত কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার সঙ্গে পাপবিদ্ধ জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে ধর্মমতে কাটাব জীবন

পাগলী, তোমার সঙ্গে পুজা বেদি জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে মধুমালা কাটাব জীবন।

দোঁহে মিলে টিভি দেখব, হাত দেখাতে যাব জ্যোতিষীকে

একুশটা উপোস থাকবে, ছাব্বিশটা ব্রত উদযাপন

পাগলী, তোমার সঙ্গে ভাড়া বাড়ি জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে নিজ ফ্ল্যাট কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার সঙ্গে শ্যাওড়াফুলি জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে শ্যামনগর কাটাব জীবন

পাগলী, তোমার সঙ্গে রেল রোকো জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে লেট স্লিপ কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার সঙ্গে আশাপূর্ণা জীবন কাটাব

আমি কিনব ফুল, তুমি ঘর সাজাবে যাবজ্জীবন

পাগলী, তোমার সঙ্গে জয় জওয়ান জীবন

পাগলী, তোমার সঙ্গে জয় কিষান কাটাব জীবন।

সন্ধেবেলা ঝগড়া হবে, হবে দুই বিছানা আলাদা

হপ্তা হপ্তা কথা বন্ধ মধ্যরাতে আচমকা মিলন

পাগলী, তোমার সঙ্গে ব্রক্ষ্মচারী জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে আদম ইভ কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার সঙ্গে রামরাজ্য জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে প্রজাতন্ত্রী কাটাব জীবন

পাগলী, তোমার সঙ্গে ছাল চামড়া জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে দাঁতে দাঁত কাটাব জীবন।

এর গায়ে কনুই মারব রাস্তা করব ওকে ধাক্কা দিয়ে

এটা ভাঙলে ওটা গড়ব, ঢেউ খেলব দু দশ কদম

পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোঝড় জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে ‘ভোর ভয়োঁ’ কাটাব জীবন।


বনলতা সেন

– জীবনানন্দ দাশ

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,

সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে

অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে

সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,

আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,

মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর

হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা

সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,

তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে;

বলেছে সে, এতোদিন কোথায় ছিলেন?

পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন

সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;

পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন

তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;

সব পাখি ঘরে আসে—সব নদী—ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;

থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।